সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলতে উদীচী আর সত্যেন সেনের চেহারাই ভেসে আসে আমার সামনে। কলেজ স্ট্রীটের বিকাল শেষে পার্ক স্ট্রীটে গিয়ে মনে হলো নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে এসে দাঁড়িয়েছি। রাস্তার দু’পাশে ব্রান্ড (সপ) গুলোর এ্যাড চোখ ধাধানো ছিলো। বুকসপ গুলো নানান সব বইয়ের সংগ্রহে ভরপুর। সপের ওপরে (উপরের তলায়) বসে মানুষ গল্প করছে। পাশে ছোট পরিসরে লাইভ মিউজিক হচ্ছে। এক জায়গায় দেখলাম একজন লেখক তাঁর বই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার আড্ডা জমিয়েছেন। বাহ্! আমাদের বেঙ্গল বই টাইপ। হাঁটছি আর ভাবছি সাংস্কৃতিক আন্দোলনটা এরা একটু ব্যতিক্রম ভাবেই ধরে রেখেছে তাহলে। আফটার অল কলকাতা। শহরটাইতো একটা লিগ্যাসি ক্যারি করে।
সন্ধ্যায় নাটক দেখতে যাবো একাডেমি অব ফাইন আর্টস এ, সেই হিসেব করে পার্কস্ট্রীট থেকে রবীন্দ্র সদনের দিকে ছুঁটলাম। রবীন্দ্র সদনে গিয়ে আমার মনে হলো আমি আমার কৈশরের শহর মাদারীপুরে এসেছি। লেকের পাড়ে বসে আছি। শিল্পকলা এ্যকাডেমি একটু পরে স্বাধীনতা অঙ্গনে নতুন নাটক মঞ্চস্থ করবে । কামাল মামা আর্টিস্টদের মেকাআপ করাচ্ছেন, সুজন ভাই শেষ মুহূর্তে স্ক্রিপ্ট দেখে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই নিয়ে সবাই কথা বলছে, অপেক্ষা করছে। আবার মনে হলো না এমন তো হয় সেগুনবাগিচার শিল্পকলায়। খানেকক্ষন পরে মনে হচ্ছিল না এতো আরেকটা টিএসসি। ক্লাস শেষে সবাই আড্ডায় মেতেছে। হা হা হা, নষ্টালজিয়া!
রবীন্দ্র সদনের পাশেই ইস্ট বেঙ্গল ফিল্ম সেন্টার। ঘোরা হলো। একটা ঘোর নিয়ে ফেরাও হলো। মাথায় তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাহলে কিভাবে চলছে। ফিল্ম সেন্টারের পাশেই একাডেমি অব ফাইন আর্টস যেখানে মঞ্চ নাটক দেখার কথা। ঢুকতেই মনে হলো চারুকলার দ্বীতীয় গেইট দিয়ে ঢুকছি। সায়ন্তনী পূতভূতন্ডের কাহিনী অবলম্বনে মৈনাক সেনগুপ্তের নাটক ‘গরল’। সম্পাদনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন সীমা মুখোপাধ্যায়। একটা পরিবার, তাদের বকে যাওয়া একমাত্র সন্তান, ১৫-১৬ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের পরে হত্যা করার মধ্যদিয়ে অপরাধের সাথে সেই ছেলের জড়িয়ে পরা, যার প্রতিবাদ স্বরূপ নিজের (েছলের) মা তাঁর সন্তানকে নিজেই হত্যা করেন। বাবা বড় উকিল হওয়া সত্বেও ছেলের জন্যে কিছু করতে পারলেন না। অত্যন্ত আদরের সন্তানকে আপসহীন ভাবে হত্যা করে মা যে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া সব ধর্ষণের বিরুদ্ধে এই তো ছিল সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন-প্রতিবাদ!
অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে। গল্প, স্ক্রিপ্ট, নির্দেশনা, অভিনয়,লাইট, সাউন্ড, মঞ্চ স্বজ্জা সব মিলিয়ে এক অসাধারণ সৃষ্টি ছিলো। নাটক শেষে বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো। তাদের নিয়মতি কাজ নিয়ে কথা হলো। কলকাতার সাংস্কৃতিক আন্দোলন আমাকে মুগ্ধ করেছে। মাথায় একটা ব্যাপারই ঘুরপাক খাচ্ছে সন্ধা থেকে যে আমাদের সত্যেন সেনের উদীচী’কে উদীচী হয়ে উঠতে হবে।
১৩বছর আগে মঞ্চে শেষ কাজ করেছি। স্মৃতিগুলো এখনো ঝকঝকে, ফ্রেমে বাঁধা। কিন্ত এখন ১৪-১৫ বছরের ছেলে মেয়েদের তেমন মঞ্চের কাছে যেতে দেখি না। স্কুল শেষে রিহার্স্যাল করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে দেখি না। সম্ভবত আমার চোখে পড়ে না। অথবা আসলে এই ট্রেন্ডই নেই। তবে স্কুলে কালচারাল ডে’র নামে একদিনের কাউবয় সাজা ছেলেমেয়েগুলো ভবিষ্যতে আর যা-ই হোক সাংস্কৃতিক অন্দোলনে কিম্বা চর্চায় বড় ভূমিকা রাখবে না (আমার মনে হয়)। বরং আন্দোলনের বিষয়বস্তু (অপরাধ) তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে (আমার ধারনা)। জেনারেশন জেড এর কাছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ‘স্বরূপ’ পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমাদেরই, জেনারেশন এক্স এবং ওয়াই এর-ই।
-ইসতিয়াক
১৩ ডিসেম্বর’১৯, পার্কস্ট্রীট, কলকাতা।