সেপ্টেম্বরের জাফলং​

September 25, 2020

নিউ নরমাল শব্দটা আমার কাছে মোটেও নরমাল লাগে না। ওয়ার্ক ফ্রোম হোম শব্দটা যতটা ক্লাসি শোনায় ভেতরটা ততটাই মানবতা বিরোধী বলে মনে হয় আমার। ২০ মার্চ থেকে ০৯ আগষ্ট ২০২০ পুরো সময়টা এক রকম বাসাতে ছিলাম। অপ্রয়োজনে রুম থেকে বের হওয়াটাও অতিরিক্ত কাজ হিসেবে ভাবতে শিখে গিয়েছিলাম। ১০ আগষ্ট থেকে ফিজিক্যালি অফিসে যাওয়া শুরু। একটু নড়াচড়া শুরু হলো। সন্ধ্যায় কিছুটা সময় পাওয়া গেল হাটাহাটি করার জন্য। সপ্তাহে তিনদিন অফিসে যাওয়া হচ্ছে দুদিন ওয়ার্ক ফ্রোম হোম। ঘুম-অফিস-বই-নেটফ্লিক্স-হইচই-হোয়াটসঅ্যাপ-স্কাইপে বেশ বিরক্তি ধরে গিয়েছে গত কয়েকমাসে। সোস্যাল মিডিয়াতে ওয়েবিনিয়ার আর লাইভ অনুষ্ঠান বোধ করি সবারই বিরক্তির কারন হয়ে আছে। এবছর কাছের, ভালোলাগার, ভালোবাসার বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুর সংবাদ আর পরিচিত অনেকেরই অর্থনৈতীক সংকটরে খবর কেমন যেন স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফোকাস হারিয়ে দিয়েছিল। ভালো অনেক কিছুই হয়েছে যেমন অফিসের প্রচুর কাজ করা হয়েছে, বেশ ভালো কিছু বই পড়া হয়েছে, গোটা পনের মুভি দেখা হয়েছে, ব্যস্ততায় যে কাছের মানুষগুলির সাথে কথা বলা হয়ে ওঠে না তাদের সাথে আলাপ হয়েছে। প্রায় সন্ধায় গুলশান-২ ডিসিসি মার্কেট, বনানী ১১ আর এআইইউবি পুরাতন ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনে আড্ডা বেশ ঘোর লাগানো ছিলো। তারপরেও ভেতরে একটা নেগেটিভ এ্যনার্জি তৈরি হয়েছিল।

নেগেটিভ এ্যনার্জি রিডিউস করতে পাহাড় আমার বরাবরই পছন্দের। পাহাড় দেখলেই আমার মনে হয় সেই যে কবে থেকে দাঁড়িয়ে আছে তবু বয়স বাড়ছে না। বয়স বাড়ছে শুধু আমার-আমাদের। আমার ধারনা পাহাড়ের সহ্য ক্ষমতা অসাধারণ যা সমুদ্রের নেই। পাহাড় নীরবতা, নিস্তব্ধতা, নিজেকে খোঁজার কথা বলে আর কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে নিজের ভেতওে থাকা নেগেটিভ এ্যানার্জি ঝেড়ে ফেলে দিতে সহায্য করে।

৩০ আগষ্ট মামা হলাম। রিয়া আপুর ছেলে বাবু হলো। জায়ান সাফওয়ান রোহান। আমাদের পরিবারে নতুন এক সদস্যর হামাগুড়ি শুরু। গত ০৯ মাসে সম্ভবত এটিই সবচেয়ে ভালো খবর ছিলো। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তায়ে হুট করেই ঠিক করলাম একটা ব্রেক দরকার। কিছু নেগেটিভ এ্যানার্জি পাহাড়ের মেঘেদের ঘাড়ে রেখে আসা দরকার। মেঘ-পাহাড়-বৃষ্টি-চা-লং ড্রাইভ- আড্ডা . . . এসব কিছু যখন ভাবছি মাথায় প্রথমে শৃমঙ্গল পরে জাফলং ভেসে আসলো।

১০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। উইকেন্ডের শুরু। অফিস শেষ করে বিয়েল ভাই আর আমি গাড়ি নিয়ে বের হলাম সিলেটের পথে। উদ্দেশ্য জাফলং এ গিয়ে মেঘ-বৃষ্টি-পাহাড় ছোঁয়া। খুবই আড্ডা দেয়ার মুডে ড্রাইভ করে আমরা সিলেট শহরে পৌঁছালাম রাত ২:৪৫ মিনিটে। রাতের সিলেট দেখলাম ঘুরে ঘুরে। লাল চা নিয়ে রাস্তায় বসে পড়লাম আড্ডা দিতে। সকাল ৫ টায় শুরু করলাম জাফলং এর পথে। তামাবিলে ভোর দেখা ছিল অসাধারণ এক অনুভূতি। টের পাচ্ছিলাম ভেতরে জমে থাকা অনেক কিছু বাস্প হওয়া শুরু হয়েছে। রাস্তার দুপাশে বিল আর সামনে আকাশ-রাস্তা মিশে গিয়ে তৈরি করেছে বিশাল এক দিগন্ত। একটু এগোতেই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি মানে মহা বৃষ্টি। পাহাড়ি ঢল এসে মিশেছে রাস্তার সাথে। গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হয়েছে বৃষ্টি কমার জন্য। জাফলং যাওয়ার পথটুকো আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। প্রশস্ত রাস্তা, দিগন্ত, লোহাড় ব্রিজ, গোছানো নদী আর খাল . . . চোখে এক অন্যরকম তৃপ্তি লেগে আছে এখনো। এই ট্রিপে আমি আমাদের সাথে জীবনান্দ দাশকে খুব মিস করেছি!

Previous slide
Next slide

এই যাত্রায় দুটো শব্দ/ শব্দগুচ্ছ আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বেসিক অব লাইফ আর পরিমিতি বোধ। বেসিক বলতে আমি সব কিছুর একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে বলে মনে করি। সব কিছুর একটা বেইস আছে বলে মনে করি। যেখান থেকে ডাল পালা গজায়, ছড়িয়ে যায়। আমার কাছে পরিমিতি বোধ হলো জীবনের কাছে প্রত্যাশার অঙ্কে জানতে হবে কোথায় গিয়ে থামতে হবে। এই থামার সীমানা জানাটাই হলো পরিমিতি বোধ।

Previous slide
Next slide

জাফলং যেতে যেতে আমরা ভাবছিলাম এই দুদিনে আমাদেরকে জাফলং, বিছনা কান্দী আর লালাখাল ঘুরতে হবে। জাফলং পৌঁছে নদী পার হতে হতে আমরা ঠিক করলাম; না আমরা জাফলংটাই দেখবো লম্বা একটা সময় নিয়ে। বাকি ২-৩ জায়গায় এই অল্প সময় গেলে যাওয়াই হবে শুধু জায়গাটা উপভোগ করা হবে না। খানেকটা ক্লান্তিবোধ তৈরি হবে। আমরা বরং খাশিয়া পল্লী দেখবো, সন্ধার জাফলং দেখবো, সকালের জাফলং দেখবো, এখানকার বাজার দেখবো, মানুষ দেখবো, কালচার বোঝার চেষ্টা করবো। ২দিনে আমরা এর বেশি কিছ্ইু করতে যাব না এবং সময়মতো ঢাকায় ফিরবো কেননা রবিবার থেকে অফিস। আমার কাছে এমন সব সিন্ধান্ত নেয়ার মানসিকতাই এক রকম পরিমিতি বোধ। 

বেসিক শব্দটা মাথায় আসলে আমি সব কিছুর গভীরে চলে যাই মনে হয়। যেকোন বিষয়েই এর উৎস কি, কিভাবে শুরু হলো, প্রথম কেমন ছিল, এর প্রথম রূপ কি, ধরন কি, চরিত্র কি ইত্যাতি ইত্যাদি। আমার চেয়ে বিয়েল ভাইয়ের ভৌগলিক ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে জানাশোনা অনেক বেশি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় এবং এখন পেশায় একজন আইনজীবি হওয়াতে কিভাবে যেন গল্পের মতো করে উপস্থাপন করে সব কিছ্।

আমারা গাড়ি পার্ক করে একটা নদী (গোয়াইনঘাট) পার হয়ে ওপাড়ে গেলাম। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। পাথুরে এক নদী মনে হলো।  ট্রলারে করে পার হয়ে খাসিয়ো পল্লীতে গেলাম আমরা। চোখে পড়লো সবুজ ধানক্ষেত তার পরে একট গাঢ় সবুজ গ্রামের গাছপালা, তার চেয়ে একটু বেশি সবুজ (খানেকটা কালো) পাহাড়ের রেখা। এমন একটা দৃশ্য আমি এর আগে কয়েক বার দেখেছি বলে মনে হল। পরে মনে পড়লো বিটিভিতে দেখেছি। খাসিয়া পল্লীর বাড়িঘর, চাপা রাস্তা, মানুষের হাটা চলা আর পানের বরজ নিয়ে তাদের ব্যস্ততা মনে করিয়ে দিল জীবন যেখানে যেমন সেখানেই তেমন করেই ব্যস্ত এবং সুন্দর। খাসিয়া পল্লীর ২-৪ জন শিশুর সাথে কথা বলে বুঝলাম তারা সুন্দর করে ইংরেজি এবং বাংলাতে কথা বলা শেখে স্কুলে। এ পল্লীকে ঘিরে ছোট একটি বাজার গড়ে উঠেছে। মফস্বল শহরের বাজারগুলির মতোই।

খাসিয়া পল্লী শেষ করে আমরা যখন বাংলাদেশ ইন্ডিয়া সীমান্তে চোখ রাখলাম তখন বেশ কয়েকটা ঝর্না চোখে পড়লো। মানুষের উচ্ছাস চোখে পড়লো ঝর্না আর জিরো পয়েন্টকে কেন্দ্র করে। একটা ব্যাপার। এটি মাঝে মাঝে আমাকে নাড়া দেয়। এই মানুষই সবচেয়ে খারাপ কাজগুলি করতে পারে পৃথিবীর জন্য, প্রকৃতির জন্য, অন্য কিছু না!

ফেরার পথে নদীটাকে আরেকটু বেশি আপন মনে হলো। ইন্ডিয়া সীমান্তে পাহাড়ের সাথে লেগে থাকা বাড়িঘর মিলে তৈরি হয়েছে ডাহুক শহর (নাম মনে হয় ভুল বললাম!)।

পৃথিবীতে এমন আরেকটি শহর আছে বলে বিয়েল ভাইয়ের দাবি, মোনাক শহর। সে এই শহরকেও মোনাক বলেই ডাকবে বলে ঠিক করে ফেলেছে এরই মাঝে।

এই যে পাহাড়, মেঘ, ঝর্না, নদী, স্রোত, পাথর আর বৃষ্টি সব কিছুরই একটা বেসিক আছে, একটা উৎস আছে, সৃষ্টির একটা গল্প আছে, একটা শুরু-শেষ আছে। হয়তো এদের সবারই একটা পরিমিতি বোধও আছে। আছে কি? না থাকলে বৃষ্টি থামতো না হয়তো, ঝর্নার প্রসত্থ বৃদ্ধি পেত, মেঘ একই জায়গায় থাকতো, নদী সব ভাসিয়ে নিয়ে চলতো, স্রোত কখনোই থামতো না। 

Previous slide
Next slide

আমার ধারণা আমাদের সবার মাঝেই রোদ, বৃষ্টি, মেঘ, ঝর্না, নদী এবং স্রোত আছে। তবে পরিমিতি বোধ কি আছে? আমাদেও সবারই একটা বেসিক আছে। আমরা সেসব বুঝতে পারি কি, ভাবি কি?

এ যাত্রায় আমরা সরকারি একটি মোটেলে উঠলমা। ৩য় তলার সবচেয়ে সুন্দর রুমটি জুটলো। গত বছর পোখারাতে ফেওয়া লেকের পাড়ে আমার যে হোটেল ছিল সেখান থেকে যেমন সুন্দর একটা মাউন্টেন ভিউ পেয়েছিলাম এখানে তার চেয়েও সুন্দর ভিউ। একটু ঘুমিয়ে দুপুরের শেষভাগ থেকে বিকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত বই পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। এমন সুন্দর ব্যালকোনিতে বসে আমি নির্দিধায় একটানা ১০-১২ ঘন্টা কাজ আর ২-৩ ঘন্টা বই পড়তে পারবো বলে আমার ধারণা।

Previous slide
Next slide

সন্ধায় বের হলাম রাতের জাফলং দেখবো বলে আর আলোচনার বিষয়বন্ত ইসলামিক রাজনৈতিক ইতিহাস।

প্রধান বক্তা বিয়েল ভাই, শ্রোতা আমি আর পাহাড়। পৃথিবী তার স্বার্থ ধরেই এগিয়েছে সব সময়। পৃথিবী তার প্রয়োজনেই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। আজকের এই আমি আর আমরা আগামীকাল পৃথিবীতে না থাকলে সিম্পলি কিচ্ছু হবে না এর। পৃথিবীর ক্ষতি না করে নিজের জীবন বোধে আনন্দ আর  বেঁচে থাকায় তৃপ্তি এনে বাঁচতে পারাটাই একরকম ভালো থাকা কিংবা সুখ। আমার কাছে তাই মনে হয়। রাতের জাফলংকে রহস্যময়ী সুন্দর করেছে সীমান্তের ওপারে থাকা ডাহুক শহর, শহরের ঘড়বাড়ি, নিভু নিভু আলো আর পাহাড়ে লেগে থাকা গাঢ় অন্ধকার।

খুব সকালের জাফলং দেখবো বলে পরদিন সকালে আমরা যখন বের হলাম তখন বাইরে বৃষ্টি। জাফলং এসে বৃষ্টিকে বৃষ্টি মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পার্ট অব লোকাল কালচার হা হা হা। একটা রেষ্টুরেন্ট এ গিয়ে বসলাম সকালের নাস্তার জন্য। রেষ্টুরেন্ট এর জানালা দিয়ে আকাশ, সাদা মেঘ, বৃষ্টি আর পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ঘরবাড়ি দেখছিলাম। এমন একটি সকাল আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম। বছর দুয়েক তো হবে। এমন একটি সকালে শুনবো বলে প্লে লিষ্টে একটি গান ও সেভ করে রেখেছিলাম। শ্রীকান্তের মেঘ পিয়ন। ঘন্টাখানেকের বেশি সময় বসেছিলাম জায়গাটাতে আর ৫-৭ বার রিপেটিডলি শুনেছি গানটি। অসাধারণ এক সকাল!

Previous slide
Next slide

দুপুরে আমরা আমরা সিলেট হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে আমরা জাফলং বোর্ডিং স্কুল আবিষ্কার করলাম। জানামতে এটাই বাংলাদেশে প্রথম বোর্ডিং স্কুল। পাহাড়ের উপরে স্কুলটি। অসাধারণ ক্যাম্পাস। এই স্কুলের ক্যাম্পাসের কথা আরেকদিন বলবো। কিছু ছবি রেখে দিচ্ছি শুধু এ যাত্রায়। আমি সম্ভবত আগামী ৪-৫ বছরে ২০-২৫ জনকে এখানে পড়তে পাঠাবো, হা হা হা।

ঢাকায় ফিরলাম রাতে। শনিবারের সমাপ্তি। উইকেন্ড এ এর চেয়ে বেশি ভালো থাকা যায় বা যেত বলে আমার মনে হয় না। গত ২-৩দিন গত হয়েছে ঘোরে, রাত দিনের প্রভেদ ভুলে। কাল রবিবার। কাল থেকে ছোঁটার দিন। তবে বেসিক আর পরিমিতি বোধ শব্দদুটো চিন্তায় ঢুকে গিয়েছে। প্রতিফলন টের পাবো আশা করি সামনের দিনগুলিতে। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে মনে হয়েছে জাফলং এ আমি পাহাড়, মেঘ, পাথুরে নদী দেখতে যাই নি। তবে যা দেখতে গিয়েছিলাম, খুঁজতে গিয়েছিলাম সেটা দেখেছি, পেয়েছি।  জাফলং অনেক কিছু দিয়েছে গত ৫০-৬০ ঘন্টায়। সেপ্টেম্বরের জাফলং ভালো থেকো।

Related Posts

Scroll to Top