শরনকোট গিয়ে সকাল দেখবো বলে ভোর ৫টায় রওনা হলাম স্কুটারে করে। পোখারায় তাপমাত্র ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তখন। হোটলে থেকে বের হয়ে ঘন্টাখানেরকরে মধ্যে পৌঁছে গেলাম শরনকোটের চূড়ায়। যেতে যেত মেঘ ভেদ করে যখন উপওে উঠছিলাম তখনকার অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। শুধু এটুকো লিখতে পারি চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছিল তবে ঠান্ডায় সম্ভব হয় নি।
শরনকোটের চূড়ায় পৌঁছে আমি ঝিম মেরে বসে ছিলাম মিনিট পাঁচেক। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখলাম খানকেক্ষন। নিচে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। উপরের আকাশ একেবারেই স্বচ্ছ। এতটা স্বচ্ছ আকাশ এর আগে আমার দেখা হয় নি। মেঘের ফাঁক দিয়ে পোখারা শহরে জ্বলে থাকা আলো দেখা যাচ্ছে। আবির রাঙা সকাল শব্দটা বইয়ে পড়েছিলাম আজ প্রথম ঠিক আবির রঙ আর আবির রাঙ্গা সকাল দেখলাম পূবের আকাশে। উত্তরদিকে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড় মাউন্ট এভারেষ্ট। পাশে জীবনান্দ দাস থাকলে আর চা খেতে খেতে তার সাথে গল্প করতে পারলে আজকের সকালকে আমি স্বর্গীয় সকাল বলতাম।
একটু একটু করে সকালের আলো ফুঁটছে আর সে আলো এসে লাগছে এভারেষ্ট এর গায়ে। একটু একটু করে নিজের স্বমহিমা নিয়ে অস্তিত্ব জাগান দিচ্ছিল এভারেষ্ট। এই প্রথম আমি এভারেষ্টকে এত কাছ থেকে দেখলাম। এতটা সুন্দর, এতটা সতেজ, আর এতটা নীরব সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। ফেসবুক নোটিফাই করলো গত বছর ঠিক এই দিনে আমি কক্সবাজারে ছিলাম। হ্যাঁ সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। একবছর আগে সেদিন ভাবিনি আজ পাহাড়ের সামনে দাঁড়াবো তাও আবার মাউন্ট এভারেষ্টের সামনে। জীবন কতটা অনিশ্চিৎ কতটা বিচিত্র! এমন মুহূর্তগুলো চোখে দেখা যায়, অভিজ্ঞতা সঞ্চার করা যায় কিন্তু আঙ্গুল দিয়ে বর্ণনা করে ফুঁটিয়ে তোলা অসম্ভব।
একটা ভোর কতটা সকাল হতে পারে তা দেখলাম। গত ৭ দিনের মধ্যে আজকেই পোখারার আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি রৌদ্রজ্জল। অনেকে শরনকোটে এসেও কুয়াশার কারনে এভারেষ্টকে এত ভালোভাবে দেখতে পারে না। আমি সেদিক থেকে ভাগ্যবান।
করনকোাট থেকে চলে গেলাম বিন্দুবাসীনি মন্দিরে। সেখান থেকে ডেভিস ফলে। ফেওয়া লেকেরে পানি ডেভিস ফল হয়ে বের হয়। ডেভিস নামে এক নারী মৃত্যু বরন করেছিলেন এই ঝর্নায়। তার পর থেকে এর নাম ডেভিস ফল। ডেভিস ফলের পাশেই গুপ্তেশ্বর গুহা বা গুপ্তেশ্বর কেইভ। গুহায় ঢুকতেই আমার একটু ভয় ভয় করছিল। সিঁড়িবেয়ে অনেকটা নিচে চলে গেলাম। এতটা গহীন নীরবতায় গিয়ে আমার মাথায় একটা শব্দই ঘুরছিল। ভয়ংকর সুন্দর। সত্যি স্রষ্টার চেয়ে বড় আর্কিটেক্ট আর নেই! গুপ্তেশ্বর কেইভ থেকে বের হয়ে চলে গেলাম ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেন মিউজিয়াম দেখতে। মিউজিয়ামটি একটা তথ্য ভান্ডার। এমন মিউজিয়াম আমাদের দেশে থাকা উচিৎ। স্কুলের শিক্ষার্থীরা এভারেষ্ট সম্পর্কে সেখানে গিয়েই জানবে। অপর্না সেন’কে তো আমরা কম বেশি সবাই চিনি। হ্যাঁ নায়িকা অপর্না সেন। তার হাসবেন্ড কল্লান রায়। ভদ্রলোক সাহিত্য পড়ান। আমি তার কন্ঠস্বরের একজন ফ্যান। তিনি যখন গ্রীক দেবদেবীদের নিয়ে পড়ান তখন ঐ অধ্যায় পড়াবার জন্য সে তার ছাত্রদেরকে ইউরোপে নিয়ে যান। দেবদেবীদের ইতিহাস যেখানে তৈরি হয়েছে সে স্থানে ঘুরে ঘুরে পড়ান। আই উইশ আই কুড হ্যাব এ চান্স টু বি হিস স্টুডেন্ট!
মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে গেলাম পিচ প্যাগোডায়। গৌতম বুদ্ধের কাছে। নীরবতা আর মানুষেকে ভালোবাসাই ছিল যার ধর্ম। পিচ প্যাগোডায় শান্তির এক ছোঁয়া আছে বলে মনে হল। যখন হাঁটছিলাম তখনো মনে হচ্ছিল শান্ত, স্থীরতা, নীরবতা আমদের নিয়ে যেতে পাওে অনেকটা দূর। নিজেকে খোঁজার জন্য মানুষকে স্থীর আর নীরব হতে হবে। পিচ প্যাগোডা থেকে ফেওয়া লেককে আরো পরিপূর্ন দেখায়। পোখারা শহরের প্রায় অর্ধেকাঁ দেখা যায়।
এভারেষ্টের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, গুপ্তেশ্বর গুহার গহীনে গিয়ে, ডেভিস ফলের প্রমত্ব ঝর্নার সামনে দাঁড়িয়ে, পিচ প্যাগোডার নীরবতায় এসে আমি শুধু আমাকে একটা প্রশ্নই করছিলাম আমি আসলে ভয় পাই কিসে। আমার ভয়টা কোথায়। অনেক কিছু ভেবে আমার মনে হলো আমর মধ্যে ফেয়ার অব রিজেকশন আছে। আমি রিজেকশনকে বা রিজেক্টেড হওয়াকে বেশি ভয় পাই। আমি অনেক কিছুই করি না, বলি না, চাই না, জানাই না রিজেক্টেড হবার ভয়ে। যেহেতু একটা বারের জন্যই বাঁচবো সেহতেু এই ভয়গুলোকে জয় করা উচিৎ। ২০২০ সালের রেজুলেশনে গেটিং আউট ফ্রম ফেয়ার অব রিজেকশন এ্যাড হলো।
আগামীকাল সকালে পোখারা থেকে কাঠমান্ডুতে ফিরছি। তবে ফেওয়া লেক, সারানকাত, মাউন্ট এভারেষ্ট, গুপ্তেশ্বর কেইভ, ডেভিস ফল আর পিচ প্যাগোডার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন। এরা সবাই আমার আমিকে খুঁজতে সাহায্য করেছে। নিজের কাছে নিজেকে বেশ স্বচ্ছ লাগছে যেমন স্বচ্ছ লাগছিলো শরনকোটে দাঁড়িয়ে আকাশকে, এভারেষ্টের চূঁড়াকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতা আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেস এ শেষ দিকে লিখেছেন –
“নিজের দু’হাত যখন নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের।
আজকাল আমার নিজের চোখ দু’টোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ।
এরকম সত্য পৃথিবীতে খুব বেশি নেই আর।”
আমার নিজের কাছেও নিজের চোখ দুটোকে একপলক সত্যি চোখ মনে হচ্ছে। নিজের অনুভূতিগুলোকে সত্য এবং স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। ভালো থেকো পোখারা, ভালো থেকো পোখারার মুক্তা ফেওয়া লেক।
-ইসতিয়াক
১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, পোখারা, নেপাল।