ফজলে হাসান আবেদ ও ব্রাক

October 2, 2021

২০ ডিসেম্বর ২০১৯, নেপাল। 
সকালে পোখারা থেকে রওনা করে বিকেলে কাঠমান্ডুতে এসেছি।আগামীকাল সকালে ঢাকায় ফেরার ফ্লাইট। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় চলে গেলাম। শরীর অসম্ভব রকম ক্লান্ত। পোখরায়  গত ৪টি দিন যেন এক ঘোরে ঘুড়েছি।হোটেলে আমার রুম দোতলয় থাকায় একটা সময় রাস্তায় মানুষের কোলাহলে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলে মনে হলো রাত ৩-৪টা বাজে হয়তো আবার মনে হলো এতো রাতে কোলাহল.. থামেল টুরিষ্টদের জায়গা.. হতেও পারে।
 
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি রাত ৮টা ১৭ বাজে। কি পরিমান গভীর ঘুমে ছিলাম টের পেলাম। ফেসবুকে ঢুকতেই স্তবির চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন বিডি নিউজের একটি খবরের দিকে। ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর বেঁচে নেই। কিছুক্ষন চুপই করে ছিলাম। জাতিগতভাবে বড় কিছু একটা হারালাম….

ব্রাকের সাথে তখন সেবা এক্সওয়াইজেড এর একটি বড় রকমের পার্টনারশীপ প্রজেক্ট লিড করছিলাম আমি। আমার টিমের সামিয়া এবং জাহিদ অপারেশন দেখছিল।

কেমন যেন এক অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। ক্ষুধাও লেগেছে। রাতে খেতে যাব বলে হোটেল থেকে বের হয়ে হাটছি। তাপমাত্রা ৬-৭ ডিগ্রি সে.। আমার জন্যে একটু আনইউজিয়ল। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে একটা কথাই মনে হচ্ছিল বারবার “স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে তুলে নেয়, মানুষ তার সৃষ্টিকে রেখে যায়”। ব্রাকই থাকলো… স্যার আবেদ চলে গেল। কতটা ব্যপৃত ছিল তাঁর জীবন!

২৬ সেপ্টেম্বর  ২০২১, ঢাকা। ফারুক ভাইয়ের (ফারুক হোসেন) সাথে মিরপুর-১২তে গেলাম একটা কাজে। লাঞ্চ শেষ করে আমি বললাম আমি রেষ্টুরেন্টে বসি আপনি কাজটা শেষ করে আসেন তার পরে অফিসের (বনানী) দিকে যাই। ভাইয়া বললো তুমি বরং আড়ং এ ঘোরাফেরা করো আমি  কাজ শেষ করে আসছি। আড়ং এর এই আউটলেটে আমার আগে কখনো আসা হয়নি। ঢুকে এটা ওটা দেখছি। হঠাৎ চোখ পড়লো একটি বইয়ের দিকে।  “ফজলে হাসান আবেদ ও ব্রাক” শিরোনামে বইটি যার লেখক গোলাম মোর্তোজা। এই ভদ্রলোকের (মোর্তোজা)  কথা আমি অনেক শুনেছি আমার সাংবাদিক সিনিয়র বন্ধুদের কাছে। তার চেয়েও মজার ব্যাপার হলো তার সহধর্মীনীর সাথে আমি কাজ করেছি সেভ দ্যা চিলড্রেনে। কিন্ত তার সাথে আমার কোনদিন সাক্ষাত হয় নি।

যা হোক হাতে যেহেতু কিছুটা সময় আছে বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু কররাম। কভার দেখলাম। ভূমিকা পড়ে তো মনে হলো এইতো খুঁজছিলাম। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৪ সালে।আমার পড়া হয় নি আগে! কিনে নিয়ে এসে রিডিং লিষ্টে যোগ করলাম। কিন্ত ঐযে ২ পৃষ্ঠা পড়েছিলাম সেই থেকে কেমন যেন মনে হচ্ছিল এখনি শেষ করি বাকিট।

রিডিং লিষ্টের ০৯ নস্বরে থাকলেও এই বৃহস্পতিবার রাতে “ফজলে হাসান আবেদ ও ব্রাক” পড়ার তালিকার সংরক্ষিত বিশেষ কোঠায় ০১ এ জায়গা করে নেয়।

গোলাম মোর্তোজা এবং স্যার ফজলে হাসান আবেদের লম্বা এক অড্ডা শুনছিলাম বলে মনে হচ্ছিল যখন বইটি পড়ছিলাম। আমি এমন লেখা পছন্দ করি যে লেখা পড়লে মনে হয় কেউ লিখছে না বরং কথা বলছে।

আড্ডায় উঠে এসেছে ফজলে হাসান আবেদের বেড়ে ওঠার কথা,  মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ফসল হিসেবে ব্রাকের যাত্রা, ক্ষুদ্রঋণ ও উন্নয়ন, ওরাল স্যালাইন, টিকাদান কর্মসূচি ও যক্ষানিরাময় কর্মসূচির কথা। তারা আরো কথা বলেছেন ব্রাকের উপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম, আডং, এনজিও ও মানব উন্নয়ন নিয়ে, এবং স্থানীয় সরকার, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে।

আমি প্রথমেই পড়েছি ক্ষুদ্রঋণ ও উন্নয়ন বিষয়ক লেখাটি। ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য নিয়ে যেমন কথা বলেছেন স্যার আবেদ ঠিক তেমনি গোলাম মোর্তোজা এর সমালোচনার দিক নিয়েও প্রশ্ন রেখেছেন এবং জনাব আবেদ প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যুক্তি এবং বাস্তবতা থেকে। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার নিয়ে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন আছে, প্রশ্ন আছে এই কার্যক্রম মানুষকে আরো বেশি গরিব বানিয়েছে কি না সে বিষয়েও। আমারও ছিল তবে বইটি পড়ে অনেকটাই পরিষ্কার ধারণা আমি পেয়েছি এ বিষয়গুলোতে। আমি পেশা জীবনেও এখন এমন একটি ইনোভেটিব প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি তাই ফজলে হাসান আবেদের ক্ষুদ্রঋণের শুরুর দিকের ভাবনাগুলো আমার জানা খুবই দরকারি ছিল।

বাংরাদেশে পোল্ট্রি শিল্প বিকাশে ব্রাকের যে এতবড় ভূামিকা সে কথা এ বই থেকেই জানলাম।

এর পরে পড়লাম আড়ং এর শুরু, বিস্তার এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা। আড়ং কিভাবে শুরু হলো, প্রডাক্ট স্ট্রাটেজি কি ছিল, টার্গেট গ্রুপ কারা ছিল, পুরো ভেল্যু চেইন  কিভাবে তৈরি হলো এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল,  ইউনিকনেস কিভাবে তৈরি করা হলো, এবং ভবিষ্যতে আড়ং কিভাবে আগানোর পরিকল্পনা করছে। আড়ং এর এই কেইসটা আমাদের বিশ্বাবিদ্যালয়গুলোতে বিজনেস ক্লাসগুলোতে পড়ানো যেতে পারে।  

মানিকগঞ্জে ভেড়েন্ডা থেকে রেসম সেখান থেকে সুতা তৈরি করে পোশাক বানানোর মধ্য দিয়ে আড়ং এর সূচনা। এই প্রথম ভেড়েন্ডাকে আমার প্রয়োনীয় কিছু বলে মনে হয়েছে। আমার জানাশোনা কম বলেই হয়তো এতদিন ভেড়েন্ডা মানে অনর্থক কিছু জানতাম।

এনজিও ও মানব উন্নয়ন নিয়ে স্যার ফজলে হাসানআবেদ কথা বলেছেন একজন অভিভাবক হিসেবে। যারা এনজিওতে কাজ করছেন এবং এনজিও তৈরি করছেন বা করবেন বলে ভাবছেন তাদের জন্য এই আলোচনা জানা জরুরী। প্রজেক্ট ডিজাইন, ফান্ড রেইজ করা, ডোনারের সাথে সম্পর্ক রক্ষা, রাজনীতি এবং এনজিওর অবস্থান কেমন হওয়া উচিড়, এনজিওর বিরুদ্ধে সমালোচনা গুলি আসলে কতটা যৌক্তিক, এ্যাডাব এর ভুলগুলি কোথায় ছিল ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা রয়েছে এ পর্বে।

আমার অন্যতম আগ্রহের জায়গা “স্থানীয় সরকার ও রাজনীতি” প্রসঙ্গ নিয়ে শেষ পর্বে যে আলোচনা হয়েছে সেখানে গিয়ে আমি কানেক্ট করতে পেরেছি স্যার ফজলে হাসান আবেদের  ব্যবস্থাপনা বিষয়ক দর্শনকে। হোক দেশ পরিচালনা কিংবা ব্রাকের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও তৈরি এবং পরিচালনা করা তার দর্শন ফান্ডামেন্টালি প্রায় একই। তিনি কতটা রাজনীতি সচেতন ছিলেন তার একটি ধারণা পেয়েছি এ অংশে।

সবশেষে পড়েছি তাঁর বেড়ে ওঠার কথা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও ব্রাকের সূচনার কথা। মুক্তিযুদ্ধের আগেই আসলে ফজলে হাসান আবেদের সামাজিক উন্নয়নে, মানুষের জন্য কাজের শুরু। সত্তরের নির্বাচনের আগে ১১ নবেম্বর রাতে দেশে খুব বড় একটি জলোচ্ছাস হয়েছিল। মনপুরা দ্বীপে  ৫৩ হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ১৩ হাজার মানুষ। ফজলে হাসান অবেদ এবং কয়েকজন মিলে ‘হেলপ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে শুরু করে বিপন্ন সেই মানুষগুলোর জন্য কাজ করা এবং তার পরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময় লন্ডনে তৈরি করেন  ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে অরেকটি সংগঠন। দেশের বাইরে থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে সে সংগঠন সহায়তা করেছিল  মুজিবনগর সরকারকে। আর স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে  তৈরি করেন ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলেটশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি’ – ব্রাক। 

গত পাঁচ বছরে আমি একটি কথা অনেকবার বলেছি বিভিন্ন জায়গায় যে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে সংগঠন করতে হবে। সংগঠন করা মানুষেরা বিং হিউম্যান  কনসেপ্ট ভালো বোঝে রাদার হিউম্যান বিং। এই বোঝাটা ভিষণ জরুরী।

এ বইয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে সংগঠন করার গুরত্বের কথা উঠে এসেছে,  রাজনীতি সচেতন  হওয়া যে কতটা জরুরী সে কথা উঠে এসেছে। উন্নয়মূলক প্রক্লপ কিভাবে  তৈরি, বাস্তবায়ন, অর্থায়ন হয় সে বিষয়ে কথা বলেছেন। একটি নন প্রফিটাবল সংস্থা কি করে আরো ১০টি ব্যবসা করে সেখান থেকে লাভের টাকা দিয়ে আরো ২০টি উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে সে বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন। সমাজের সমস্যা সমাধান করে কিভাবে ব্যবসা করা যায় সে কথা বলেছেন। নারীুদের কিভাবে উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা যায় সে বিষয়ে বলেছেন। নতুন ব্যবসা শুরু, পোডাক্ট তৈরি করা, ইনভেষ্টর ম্যানেজ করা, কেপিআই সেট করা, ব্যবসায় লাভবান হওয়া ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতাগুলোর কথা বলেছেন সমস্ত আলোচনা জুড়ে।  আমি অবাক হয়েছি এটা জেনে যে সে ব্রাক এর প্রতিটি উইংস এর হাই লেভেল কেপিআই, ইউনিট ইকোনমিকস, এবং লং টার্ম গোলসগুলো পরিষ্কার ভাবে মাথায় নিয়ে ঘোরেন। 

♦ ফজলে হাসান আবেদ ও ব্রাক – বই সম্পর্কে চোখ বন্ধ করলে যে বিষয়গুলি আমার মাথায় ঘুরবে-

১.  প্রকৃত লিডারশীপ প্রশিক্ষন দিয়ে তৈরি করা যায় না।যার যোগ্যতা দক্ষতা যে দিকে তাকে সে দিকেই কাজ করেত দিলে ফলাফল ভালো আসে।

২. স্বাধীনতা পরবর্তী সরকাল দেশ চালানোর ক্ষেত্রে স্ট্রাটেজিক বেশ কিছু ভুল করেেছিলেন। অযোগ্য এবং চাটুকারদের ক্ষমতায়ন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাজউদ্দীন আহমেদকে আরো বেশি ক্ষমতায়ন করা উচিত ছিল। 

৩. সাম্প্রতিক আফগান তালেবান সংকটে সোস্যাল মিডিয়া যে ভূমিকা রেখেছে/ রাখছে ঠিক সেরকম ভাবে তবে আরো বেশি ইফেক্টিভ ভূমিকা রেখেছিল ১৯৭১ এ তৈরি হওয়া অ্যাকশন বাংলাদেশের মতো সংগঠনগুলি।

৪. ছোট লোনের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্য না নিলে ব্যবসা ভায়াবল হবে না, অপারেশন চলবে না। গরীব মানুষকে শুধু লোন দিলেই চলবে না তারা কিভাবে সেটা ব্যবহার করবে সেটাও শেখাতে হবে।

৫. ব্রাক লোন দেয় এবং তার সাঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে চেষ্টা করে আর গ্রামীন ব্যংক লোন দেয় তবে লোন নিয়ে কি করবে সে ব্যাপারে দায়িত্ব নেয় না- ফান্ডামেন্টাল পার্থক্য। 

৬. নন প্রোফিটাবল সংস্থা ব্যবসা করে লাভের টাকা দিয়ে নন প্রফিটাবল আরো দশাটি কাজ করবে এটি বৈধ এবং ব্রাক তার বড় একটি মডেল। অতএব আমাদের বলা বন্ধ করতে হবে ব্রাক তো কোন ব্যবসা করাই বাদ দিলো না! সরকার সঠিক ভূমিকা রাখলে এনজিওর ব্যবসায় নামতে হবে না।

৭. আমাদের স্কুলগুলোকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় স্থান এবং শিক্ষকেদেরকে প্রিয় মানুষ হয়ে উঠতে হবে। পৃথিবীতে যারা যে বিষয়গুলি ভালো ভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন যেমন জাপান বিজ্ঞান শেখায় ভালো, সুইজারল্যান্ড ম্যাথস, ইতালিতে ইলেমেন্টারি স্কুল ব্যবস্থা নামকার তাদের কাছে থেকে আমাদের শিখতে হবে।

৮. একজন উদ্যোক্তার  খুব ভালো  করে তার ব্যবসায়ের উইনিট ইকোনোমি সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। লিডারকে জানতে হবে কোথায় যাব, কি চাই, কেন চাই। মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট নেতৃত্ব তৈরির বড় অন্তরায়। লিডার হিসেবে সহায়ক ভূমিকা রাখতে গিয়ে মাইক্রো ম্যানেজ করা যাবে না। 

৯. ব্যক্তি নির্ভর দেশ, সমাজ, সংস্থা কোন কিছুই বেশিদিন টিকবে না। নিজস্ব অবকাঠামো এবং নেতৃত্বর গুরুত্ব অপরিসীম।

১০. জীবন ব্যপৃত করতে হলে মানুষের জন্য কাজ করা উচিত। তৃপ্তি সেখানেই বেঁচে থাকার স্বার্থকতাও। 

গোলাম মোর্তোজা একটি ভালো কাজ করেছেন এই বইটি নিয়ে কাজ করে। এই বইটি আমাদের জন্য একটি সম্পদ। আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা অন্তহীন, জনাব মোর্তোজা। 

 
-ইসতিয়াক
০২ অক্টোবর’২১, ঢাকা।

Related Posts

Scroll to Top