ফটো: সারাংকোট, পোখারা, নেপাল, ২০১৯
একঘেঁয়ে হয়ে পড়ার ভয় শুধু মানুষের না, প্রকৃতিরও আছে। তা না হলে প্রতিদিন সকাল হতো না, আলো ফুটত না। পৃথিবীতে শুধু দিন কিংবা রাতই থাকত। প্রকৃতি নতুনত্ব চায়। মানুষ তো প্রকৃতির বড় একটা অংশ। তাই একঘেঁয়ে হয়ে পড়া কিংবা নতুনত্বের খোঁজে অপরাধবোধের কিছু নেই। বরং কোন স্কেলে নতুনত্ব খুঁজব এবং কোন রকমের আর্টে খুঁজব— সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ভীষণ পছন্দের স্থান, সময়, মানুষ সবসময় ভালো লাগার অনুভূতি দেবে, এটা তাদের দায়িত্ব না, তেমনি সে আশা করাও বোকামি। বরং নিজের চিন্তার ফিল্টার পরিবর্তন করতে হবে নির্দিষ্ট সময় পরপর। যদি সমুদ্র ভালো লাগে তবে সবসময় সমুদ্রই ভালো লাগবে কিংবা সেখানেই যেতে হবে, এমন নয়। মাঝে মাঝে ধানক্ষেতেও হাঁটতে হবে, নদীর ধারেও যেতে হবে। এতে করে সমুদ্র অবহেলিত হবে না বরং ভালো লাগায় নতুন মাত্রা যোগ হবে।
বৃষ্টির শব্দের মতো জীবনের সুর যারা নিজের মতো করে বাঁধতে পেরেছে, তারা সফল। সফলতা বস্তগত এবং অবস্তুগত। অবস্তুগত সফলতা (ভালো থাকা) বস্তগত সফলতা এনে দেয়। তবে বস্তগত সফলতা (আমার ক, খ, গ আছে) অবস্তুগত সফলতা আনে খুব কম সময়। অবস্তুগত সফলতা আমাদেরকে ভিন্ন করে, আলাদা করে, জীবনের নিজস্ব সংজ্ঞা দেয়। জীবনের একটা সংজ্ঞা থাকা জরুরি।
আমরা কেউ কোনোদিন আমাদের মতো করে সুখী হব না। আমরা প্রকৃতির মতো করে সুখী হব— হই। এ কারণেই আমরা কখনোই সুখী নই বলে মনে করি, যদিও আমরা সুখী। মানুষ তার নিজের মতো করে সুখী হতে পারে না। প্রকৃতি শেখায় নীরবে সতেজ থাকতে, বাতাসে দোল খেতে। প্রকৃতি শেখায় অন্যের ভালো হওয়ার কারণ হতে। প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজে যেন একঘেঁয়ে হয়ে না পড়ে। তাই বলে কদমফুল গাছ গোলাপ গাছ হয়ে যায় না, বরং নতুন পাতা, রং, ফুল, ফল নিয়ে নিজেকে নতুন করে সাজায়। আমাদের প্রকৃতির মতো বদল হওয়া উচিত, সময় সময়ে। প্রকৃতি সুন্দরতমকে ভালোবাসে। তা না হলে পৃথিবীর বনগুলো এত সুন্দর হতো না। প্রকৃতি ফ্যাকাসে ভাব পছন্দ করে না, তাই তার রং ফ্যাকাসে নয়। ‘আমরা কেন ফ্যাকাসে হই?’ ‘আমরা গাছের মতো হতে পারি না?’ গাছ ঝগড়া করে নীরবে, নিজেকে বদলে নেয় সময়ে সময়ে, চারপাশকে ভালোবাসে নিভৃতে। আমরা প্রকৃতির মতো করে সুখী না হয়ে বিশ্বায়নের মতো করে সুখী হতে গিয়ে আমরা আসলে কিছুই না হয়ে কনফিউজড হয়ে যাই। প্রকৃতি কনফিউজড না। তা না হলে একটি নদী চলতে চলতে গাছ হয়ে যেত, কোনো একদিন দুপুর দাঁড়িয়ে থাকত, রাত নামত না। প্রকৃতি জানে সে কী চায়, কী করবে। আমাদের প্রকৃতির মতো হওয়া জরুরি, না হলে সুখী হব না আমরা। সবকিছু ঠিকঠাক চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নিজেকে বদলে নিতে হবে প্রকৃতির মতো।
ট্রেনের জংশন থাকে, বাসের ডিপো থাকে, প্লেনের হ্যাঙ্গার থাকে, পশুপাখির অভয়ারণ্য থাকে। ‘কেন থাকে?’ নিজেদের রিপেয়ার করার জন্য, ফুয়েল নেওয়ার জন্য, নতুন উদ্যমে শুরু করার শক্তি সঞ্চারের জন্য, নিশ্চিন্তে বাঁচার জন্য, ঘুরে বেড়ানোর জন্য। মানুষেরও তেমন জংশন প্রয়োজন। কারো থাকে, কারো থাকে না। এই না থাকাটাই ভালো না থাকার, ক্লান্ত হয়ে পড়ার প্রধানতম কারণ। মানুষ, স্থান, স্মৃতি, জ্ঞান মিলে মানুষের জীবনে এমন জংশন তৈরি হয় বা করতে পারে। নিজের জংশন খোঁজা জরুরি। না হলে ক্লান্তি তোমাকে ক্ষমা করবে না।
স্বপ্নের ভেতরে ঢুকে স্বপ্নকে হারিয়ে ফেললে ভীষণ ক্লান্ত লাগে। জীবনের মধ্যে জীবন হারালে, সম্পর্কের মধ্যে সম্পর্ক, সংসারের মধ্যে সংসার হারিয়ে ফেললেও তাই। হারানো যাবে না। বরং নিজের ভেতরে ভেতরে পরিবর্তন আনতে হবে ষড় ঋতুর মতো। নিজেকে নতুন করতে হবে, সবুজ, সতেজ, উদ্যমী করতে হবে নিজের স্বকীয়তা বদলে না ফেলে। কোনো কিছুই বদলানোর দরকার নেই। তুমি তোমার ভেতরে গ্রীষ্ম থেকে হেমন্ত আনো, শীত থেকে বসন্ত। সৃজনশীল হও, নিঃশ্বাস নাও, স্বপ্ন দেখো, নিজেকে নিজেই ভালোবাসো, শক্তি দাও, এবার হাঁটা শুরু করো আবার।
জীবন সুন্দর সকালের আলোর মতো। জীবন নতুন প্রতি ভোরের মতো। জীবনে মন্দ লাগা আছে সন্ধ্যার মতো। এই সবই জীবন। জীবনে কাম আছে, কামনা আছে, প্রেম আছে, বাসনা আছে। কোনটাই অস্বীকার করার নয়। শুধু নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে হবে। কারো গোলাপ প্রিয় ফুল, কারো কচুরিপানা। ফুল মূখ্য বিষয় নয়, এখানে ভালো লাগাই গুরুত্বপূর্ণ। দেহের ভাষা কখনো মিথ্যে বলে না। দেহতত্ত্ব আর মনস্তত্ত্ব সমান্তরাল না হলেও কাছাকাছি হাঁটে। সেভাবেই হাঁটানো উচিত। সমান্তরাল করতে পারলে তুমি অতিসুখী হবে।
বড় একটা নিঃশ্বাস নাও। প্রথম থেকে আবার পড়ো। আমি তাই বলি যা বিশ্বাস করি।
-জুলাই, ২০১৯