সকাল চারটায় হোটেল থেকে বের হলাম এয়ারপোর্টে যাব বলে। কলকাতা থেকে দিল্লির ফ্লাইট ছিল ছয়টা পয়তাল্লিশে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি কলকাতার আর্ট ফিল্ম দেখতাম বেশ। সেসময় থেকেই কলকাতা শহরকে ঘুম থেকে উঠতে দেখার একটা ইচ্ছা ছিল মনের ভেতরে। আজ সুযোগ করে নিলাম। একটু আগেই বের হয়ে টেক্সি করে মিনটি চল্লিশেক শহরের এদিক সেদিক ঘুরে চলে গেলাম এয়ারপোর্টে। ঘন্টা দুয়েকের এক ফ্লাইটে কলকাতা থেকে দিল্লি পৌঁছে গেলাম। দিল্লি নেমেই দেখি তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথচ ঘন্টা দুয়েক আগে কলকাতায় ২৪ ডিগ্রি রেখে এসেছি। সময়ের ব্যবধানে দূূরত্ব বাড়ে, চেহারা ও ধরন পাল্টায় শহর, মানুষ আর পৃথিবী।
দিল্লিতে খুবই ছোট একটা কাজ শেষ করে ফের এয়ারপোর্টে ফিরতে গিয়ে মোটামুটি ফার্মগেইটকে মনে পড়লো। ওভার ব্রীজের জন্য নয় জ্যামে বসে থেকে। সব শহরেই নেগেটিভ এনার্জির ধরণ বোধহয় একই রকম হয়!
দিল্লি থেকে বিকালে নেপালে আসার ফ্লাইট। মাঝে একটু সময় পাওয়া গেল। এয়ারপোর্ট এর ভিতরে বইয়ের দোকানে চলে গেলাম বই আর ম্যাগাজিনের সংগ্রহ দেখার জন্য। আমি আরো একবার হারালাম মনে হচ্ছিল। এত এত বই, এত এত ম্যাগাজিনের সংগ্রহ দেখে! একটা জাতি কতটা সমৃদ্ধ সেটা টের পাওয়া যার তাদের জাদুঘর আর বইয়ের দোকানগুলোতে গেলে।
বিকালের ফ্লাইটে কাঠমমান্ডু জন্য রওনা হলাম। নেপালে যাওয়ার উদ্দেশ্য কলকাতায় আসার থেকে একেবারেই ভিন্ন। নেপালে আমি মানুষ দেখবো না। সংস্কৃতি দেখবো না। ইতিহাস কিংবা লিগ্যাসি খুঁজবো না। নেপালে আমি পাহাড়, আঁকাবাঁকা রাস্তা, কুয়াশা, সাদা মেঘ, আর সূর্য দেখতে যাচ্ছি। নেপালে আমি কবিতা পড়তে যাচ্ছি। কবিতা লিখতে যাচ্ছি। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিতে যাচ্ছি। ‘উনিশে ইসতিয়াক’ এর পূনর্তা দিতে যাচ্ছি।
সেল্ফ ব্রাইব বলে ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে। মানে নিজেকে নিজের কিছু উপহার দেয়া। শুধু শুধু না। কোন একটা বিশেষ কারনে। এই যে ‘উনিশে ইসতিয়াক’ এর আয়োজনটা এই পুরো ব্যাপারটা আমার নিজের জন্য নিজেকে দেয়া এক সেল্ফ ব্রাইব। সেল্ফ ব্রাইব সেল্ফ মোটিভেশনের এশটি অংশ। সেল্ফ মোটিভিশনের মধ্যে মূলত এক্সটার্নাল এবং ইন্টার্নাল মোটিভেশ ফ্যাক্টরস বা মোটিভেটরস রয়েছে। ইন্টারনাল মোটিভেশন/মোটিভেটর হলো এমন যে আমরা কোন একটা কাজ শুরু করেছি। হয়তো পরিকল্পনা থেকে কিছুটা এদিক সেদিক হয়েছে। মানুষ সেসব নিয়ে সমালোচনা করা শুরু করে দিয়েছে। এত কিছুর পরেও যখন আমরা ভাবি যে কাজটা অমরা আসলেই পরিকল্পনা মতো শেষ করতে পারবো এবং শেষ করলে বড় একটা পজেটিভ ইমপ্যাক্ট তৈরি হবে তবে সাময়িক ভাবে যে নেগেটিভ এনার্জি (সমালোচনা) তৈরি হয়েছে সেটাকে আমরা শক্ত হাতেই ডিল করতে পারবো এই যে নিজেকে-নিজেদেরকে লক্ষ্যে অুঁট রাখার জন্য যে ভেতরের চেষ্টা এটাই ইন্টাার্নাল মোটিভেটর। আর এক্সটার্নাল মোটিভেটরদের মধ্যে একাউন্টেবিলিটি পার্টনার, একাউন্টেবিলিটি গ্রুপ আর সেল্ফ ব্রাইব গুরুত্বপূর্ণ।
কাঠমান্ডু ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করতে ডিলে হচ্ছিল প্রায় ২৫-৩০ মিনটি। কাঠমান্ডুর আকাশে ঘুরছে ইন্ডিগো। আমি জানালায় চোখ রেখে সাদা মেঘ দেখছি। মেঘকে এতটা কাছের কখনোই মনে হয় নি। পাহাড়ের গায়ে মেঘকে জড়িয়ে থাকতে দেখলাম। পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাড়ি ঘরের কোন নির্দিষ্ট নকশা না থাকলেও কেমন যেন একটা শৈল্পিকতা রয়েছে সেগুলোতে। উপর থেকে তাই মনে হচ্ছিল। এমন একটি বিকালের জন্য আমি অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে ল্যান্ড করলাম নির্ধারীত সময়ের ৪০ মিনিটি পরে। সব খারাপ, খারাপ না। ল্যান্ড করতে ডিলে হয়েছে তবে কাছ থেকে মেঘকে তো দেখা হয়েছে, হা হা হা। প্লেন থেকে নেমে অনুভব কলাম তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশেপাশে। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে টের পেলাম জীবনে এতটা সতেজ হাওয়া/ফ্রেশ এয়ার এর আগে কথনো নেই নি আমি। আজই প্রথম নিলাম। বুক ভরে লম্বা নিঃশ্বাস নিলাম। চোখের সামনে পাহাড়ের বুকে মেঘের খেলা, বুকের মধ্যে বিশুদ্ধ বাতাস, আর মাথায় জীবনানন্দ দাসের শংখমালা কবিতার কয়েক লাইন-
“খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি, কুয়াশার পাখনায়
সন্ধার নদীর জলে নামে যে আলোক জোনাকির দেহ হতে
খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে।
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রােেণর অন্ধকারে ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমাকে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।”
-ইসতিয়াক
১৬ ডিসেম্বর’১৯, কাঠমান্ডু, নেপাল।