উনিশে ইসতিয়াক – ৪

March 16, 2020

কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছিলাম আজ যা কিনা একই সাথে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও। রবীন্দ্রনাথের কয়েক হাজার স্মৃতি দৃশ্যমান রয়েছে বাড়িতে। আর আমরা যারা রবীন্দ্রনাথকে বড় একটা সময় ধরে পড়ছি তারা এ বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজে পাবেন তাঁকে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের আঁতুড় ঘর থেকে ২২শে শ্রাবণ তার প্রয়াণ ঘর সবই নিজের চোখে দেখলাম। আমার গুজবাম হচ্ছিলো কেন জানি। অর্ধেকটা দিন ধরে আমি হেঁট হেঁটে পুরো বাড়িটা ঘুরেছি। একই জায়গায় একাধিকবারও গিয়েছি। বাড়ি থেকে কেন যেন বের হতে ইচ্ছে করছিলো না। সত্যি মানুষ তার সৃষ্টি রেখে যায়, স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চলে যায়।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির বারান্দায় হাটছিলাম আর মাথায় একটা শব্দ ঘুরছিল ‘সম্পর্ক’ হ্যাঁ রিলেশনশিপ। সম্পর্কের আবহে জীবনের শুরু, সম্পর্কগুলোই আমাদের সয়ংসম্পূর্ণ করে পরিপূর্ণতা দেয়, সম্পর্কই আমাদের ধূসর কিংবা রঙ্গিন করে আবার এই সম্পর্ক ছেড়েই আমদের চলে যেতে হয়। সম্পর্ক জটিল, সম্পর্ক কূটিল, সম্পর্ক মিষ্টি, সম্পর্ক তেতো, সম্পর্ক সরল, সম্পর্ক গরল, সম্পর্ক সাদা, সম্পর্ক কালো, লাল, ধূষর, বেগুনী, সম্পর্ক বাঁকা, সম্পর্ক সোজা, সম্পর্ক সংগায় পূর্ণ, সম্পর্ক সংগাহীন . . . কত কি!

আমি জানতাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু আর মহাতœা গান্ধীর বন্ধুত্ব ছিলে। কিন্ত আজ স্পষ্ট মনে হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথের জগদীশ চন্দ্র বসু আর মহাতœা গান্ধীর সাথে একটা জেনুইন রিলেশনশিপ ছিলো। জেনুইন রিলেশনশিপ ব্যাপারটা সস্তা কিছু নয়। একটা জেনুইন রিলেশনশিপ একদিনে কিংবা সহজে গড়ে ওঠে না। জেনুইন রিলেশনশিপ আসলে কি? আমার কাছে নিজের সহজ স্বীকারোক্তির বা নিজের ভেতরকার আমির সহজ প্রকাশের জন্য নির্ভরযোগ্য যে ব্যক্তি তার সাথে যে সম্পর্ক তাই জেনুইন রিলেশনশিপ। ইতস্ততাবোধ, অহমিকাবোধ, স্বার্থ, ঘৃনা, হিংসা, নেতিবাচকতাহীন সম্পকর্ই জেনুইন রিলেশনশিপ। সহজ, সুন্দর ও অর্থবহ ভাবে বাঁচতে এমন সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা এখনো রবীন্দ্রনাথ- জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ- মহাতœা গান্ধীর সম্পর্ক নিয়ে জানেন না তারা গুগল করতে পারেন। জেনুইন রিলেশনশীপ আর পলিম্যাথ নিয়ে একটু পড়াশুনা করে ফেলুন। আমি হিসাব করে দেখলাম আমার সাথে জেনুইন রিলেশনশিপ থাকা মানুষের সংখ্যা এতই অল্প যে গুনতে এক হাতের সবগুলো আঙ্গুলও দরকার পড়লো না। অথচ কত মানুষের সাথে কত রকম সম্পর্ক! এবার নিজেকে জিঞ্জেস করুন। দেখেন হাতের সব আঙ্গুল শেষ হয় কি না।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে অন্যতম স্মার্ট একজন মানুষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে জেনুইন রিলেশনশীপ ছিল তবে সে প্রায় প্রতিটি সম্পর্ককেই আলাদা আলাদা করে পরিচর্যা করতেন। ভালো রাখতেন। এটা কিন্ত বড় রকমের একটা আর্ট। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথকে এশারনে বেশ স্মার্ট এক মানুষ মনে হয় সবসময়। একই মানুষের সাথে আমাদের চার রকমের কাজ থাকতে পারে চার রকমের সম্পর্কও থাকতে পারে। ২-১টা কাজে মতের অমিল হলে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াটা একরকম আনস্মার্টনেস বলে মনে হয় আমার কাছে। বরং প্রতিটি সম্পর্কই হওয়া উচিত আলাদা, স্বকীয়। রবীন্দ্রনাথের সাথে যেমন ছিল মহাতœা গান্ধীর, যেমন ছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর।

জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা আসলে বিজ্ঞানের কথা তো মাথায় আসবেই। বিকালে এখানে সায়েন্স সিটি দেখতে গিয়েছিলাম। প্যানারোমা অন হিউম্যান ইভল্যুশন, ডার্ক রাইড (পৃথিবী জন্মের রহস্য), আর এ্যাস্টেরিও মিশন থ্রিডি শো আমি বেশ উপভোগ করেছি। আমাদের নভোথিয়েটার টাইপ তবে এখানের সায়েন্স সিটি আরো বেশি সমৃদ্ধ। মুগ্ধ হবার মতো। শহরের মাঝে পুরো পরিবার নিয়ে ছুটির দিনগুলোতে বেড়াতে যাবার জন্য এমন সব আয়োজন থাকা ভালো। কেননা আজ ৭ বছরের যে শিশুটি আমার পাশে বসে তাঁর বাবা মায়ের সাথে এস্টেরিও মিশন দেখলো কে জানে ওর মনে কি দাগ কেটেছে। হয়তো সে কোন একদিন নাসার হয়ে কাজ করবে। অথবা তার চেয়ে আরো বড় কিছু। মিলেনিয়ামরা কি ভাববে, কিভাবে ভাববে তার প্রাথমিক বিষয়বস্তু তো আমাদেরকেই সাজিয়ে দিতে হবে।

ওদেরকে এটা ওটা করা যাবে না না বলে পলিম্যাথ হবার কথা বলতে হবে। একসাথে অনেক বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার কথা বলতে হবে। সম্পর্কগুলোকে জেনুইন রাখার/ করে তোলার কথা বলতে হবে। প্রতিটি সম্পর্ককে আলাদা করে গুরুত্ব দেবার কথা বলতে হবে। মানুষের কল্যানে বিজ্ঞানের কথা বলতে হবে। আর এই সব কিছু থেকেই ওরা ওদের জীবন যাপনে এক শৈল্পিকতা খুঁজে পাবে। বাঁচার ভেতরে, জীবন বোধে, প্রতিদিনকার জীবনে শৈল্পিকতা থাকা মানে জীবন-বেঁচে থাকা অনেকাংশে স্বার্থক।

যেমন স্বার্থক জীবন ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাতœা গান্ধী, জগদীশ চন্দ্র বসুর বলে মনে হলো সারাটা সকাল জোড়াসাঁকোতে।

-ইসতিয়াক
১৫ ডিসেম্বর’১৯, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, কলকাতা।

Related Posts

Scroll to Top